আরব বিশ্বের ট্রাজেডি

আরব বিশ্বের ট্রাজেডি ও তার প্রকৃত কারণ

কুরআনের আলোকে কারণ অনুসন্ধান

এ সমস্ত ঘটনাগুলো যত গভীর দৃষ্টিতে দেখব, বা কুরআনের আলোকে কারণ অনুসন্ধান করব, তাহলে কুরআনে কারীমের মুজিযা সংবলিত ঐ সম্পূরক শব্দের থেকে উপযুক্ত আর কোন শব্দ পাওয়া যাবে না, যাকে কুরআনের ভাষায় “খুযলান/ লাঞ্ছনা” বলা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

إِنْ يَنْصُرْكُمُ اللَّهُ فَلَا غَالِبَ لَكُمْ وَإِنْ يَخْذُلْكُمْ فَمَنْ ذَا الَّذِي يَنْصُرُكُمْ مِنْ بَعْدِهِ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ

যদি আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করে তাহলে কেহ তোমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না। আর যদি তিনি তোমাদেরকে লাঞ্ছিত করেন তাহলে কে আছে? তার বিপরীতে তোমাদেরকে সাহায্য করবে। আর মুমিনদেরকে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করা উচিত। (আলে ইমরান-১২০)
চিন্তার বিষয়
আমাদের ভাবনার বিষয় হচ্ছে, এই লজ্জাজনক পরাজয় ও বিশ্ববাসীর সামনে অপদস্থ আমরা কেন হলাম? কাল পর্যন্ত যাদের উপর আল্লাহর সাহায্য অবতীর্ণ হচ্ছিল, সফলতা আর কামিয়াবি যাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, আল্লাহর সাহায্য যাদেরকে সঙ্গ দিচ্ছিল, আসমানি সৈন্য যাদের সাহায্যের জন্য অবতীর্ণ হচ্ছিল, এমনকি মুসলমান, বিশেষত আরবদের এ বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল যে, আল্লাহর সাহায্য প্রতিটি যুদ্ধের তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে গিয়েছে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাস এর বিষয়টি তো সত্য ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, জ্ঞান ও যুক্তির বিচারেও সঠিক ও বৈধ। স্রষ্টা ও তার সৃষ্টি উভয়ের কাছেই সাহায্য ও সহযোগিতার বিষয়।
অন্যদিকে ইসরাইলিরা অত্যাচার-অনাচার, দখলদারি মানসিকতা এবং আত্মম্ভরিতার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। অভিশপ্ত ইহুদিরা আল্লাহ তায়ালার নিকৃষ্টতম সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত এবং সর্বাধিক নিচু ও দাস স্বভাবের বলে পরিচিত। নতুন প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্র (ইসরাইল) এর বাসিন্দারা বিভিন্ন গোত্র ও বর্ণের সমষ্টি। এর থেকেও বিশুদ্ধ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হবে ব্যাঙ্গের ছাতার মত।
যারা দুনিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে এখানে এসে একত্রিত হয়েছিল, আরব দেশগুলো এদেরকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল যেমন গলার হার অথবা শিকলের মত। এদের অবস্থা এমন ছিল যে, একটি উত্তাল মহাসমুদ্রের মাঝে ছোট একটি দ্বীপ।
তাদের সম্পর্কে আল্লাহর বাণী-

وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ-

আর তাদের উপর লাঞ্ছনা ও দরিদ্রতা ছেয়ে গেছে, আর তারা আল্লাহর গজবে নিপতিত।
তিক্ত বাস্তবতা
প্রকৃত বাস্তবতা আসলেই তিক্ত, তা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা আরবদেরকে ইসলাম প্রচারের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাদের উপর ইহার হেফাজত, তাবলীগ ও দাওয়াতের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে এ বিষয়ে আদিষ্ট করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা তাদের ভাগ্যে ইসলাম এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি এর আগমনকে এমনভাবে সম্পৃক্ত করেছেন, এবং একটাকে আরেকটার সাথে এমনভাবে সংযুক্ত করেছেন যে, পৃথিবীর কোন শক্তিই এ দুটোকে আলাদা করতে পারবে না। এটা তাদের অন্তরে ইসলাম প্রচারে আগ্রহ এবং দাওয়াতের অসীম উদ্দীপনা আর ইমানের উত্তাপ সৃষ্টি করেছে।
তারা মানবতার চিন্তায় অস্থির ও পেরেশান থাকতো। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি (যা তাদেরকে অন্য জাতি থেকে পৃথক করেছে, এবং যাদেরকে ইসলাম সফলতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়েছে এবং সঠিক পথের দিশা দিয়েছে)
তাদেরকে তাদের ঐ সমস্ত শত্রুর উপর বিজয়ী করেছে, যাদের সংখ্যা দশ গুণেরও বেশী ছিল। আর ঐ রোম ও পারস্যের উপর বিজয় দান করেছে যাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর মত কেহ সে সময় ছিল না।
সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি হচ্ছে, দ্বিধাহীন বিশ্বাস, ইসলামের সাথে বিশ্বস্ততা, আত্মত্যাগ ও কুরবানির মানসিকতা, নিজেকে মিটিয়ে দেয়ার মানসিকতা, আমিত্ব ও আত্ম-অহমিকা পরিত্যাগ, নিষ্কলুষ চরিত্র, অল্প-তুষ্টি ও পরহেজগারি জিন্দেগী এবং স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে বাস্তবতার উপর বিশ্বাস।
কিন্তু এই শেষ যুগে এসে আরবদের মধ্যে এমন কিছু ঘটনা ও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যা ঐ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছে এবং তাদের ঐ চারিত্রিক ভিত্তিকেই দুর্বল করে দিচ্ছে, যার উপর পুরো ভবনের স্তম্ভগুলো দণ্ডায়মান। তারা সেই আরব বিশ্ব, যাদের উপর ইসলামের ভিত্তি নির্ভরশীল এবং যারা ইসলামের জন্য জীবন ত্যাগ করতে কার্পণ্য করত না তাদের স্থানে সম্পূর্ণ একটি নতুন আরব বিশ্ব গঠন করতে যাচ্ছে, যারা সেই জগত থেকে মৌলিক ও ভিত্তিগতভাবেই ভিন্ন। এই ঘটনা ও পরিবর্তন এবং সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক, এবং যেগুলো ঐতিহাসিকভাবেই কাজ করে যাচ্ছে।
পশ্চিমা সংস্কৃতি ও ধন-সম্পদের প্রাচুর্য
পরাজয়ের প্রথম কারণ হচ্ছে, পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের সেই ঢেউ যা কি না ঐ দেশসমূহের উপর দিয়ে তুফানের মত বয়ে গিয়েছিল। ঐ সংস্কৃতি ও ধন-সম্পদের প্রাচুর্য সে সমস্ত সৈনিক ও মুজাহিদ মানসিকতার উম্মত, যারা নিজস্ব স্বভাব এবং ঐতিহাসিক সম্মানের উপর ভিত্তি করে জিহাদ করে থাকে, এবং বিপদে অটল, দাওয়াত ও প্রচারের কাজি দুনিয়া বিমুখ ও সাদাসিধে জীবন যাপন পছন্দ করত তাদের উপর সুগভীর প্রভাব ফেলল । বরং তাদের জীবনের রংই পালটে দিল। তাদের মধ্যে বিলাসিতা, আরামপ্রিয়তা এবং ঘরকুনো স্বভাব সৃষ্টি হল।
জীবন বাজি, বিজয় অর্জন, বিপদে অবিচল, বীরত্ব প্রদর্শন, আত্মনির্ভরশীলতা, আপদে-কষ্টে ধৈর্যধারণ এবং জীবন-যুদ্ধে অটল থাকার গুণাবলি রূপকথার কাহিনীতে পরিণত হল।
আল্লাহ তায়ালার হুকুম এবং ফরায়েজসমূহের গুরুত্ব মানুষের দৃষ্টিতে কমে গেল। নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ এবং আল্লাহর হুকুমের নাফরমানি ও বিরুদ্ধাচরণ সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হল। উলামায়ে কেরাম আমর বিল মারুফ (সৎকাজের আদেশ) ও নাহি আনিল মুনকার (অসৎ কাজের নিষেধ) এর ফরজ ছেড়ে দিল, আত্ম-সমালোচনা ছেড়ে দিল, নিষ্ঠুর অত্যাচারী বাদশাহ ও স্বৈরাচারী আমীরদের সম্মুখে সত্য বলার অভ্যাস চিরতরে বিদায় নিতে থাকল। নির্লজ্জতা, নাফরমানি, পাপাচার , অবাধ্যতা ও নাস্তিকতা প্রসারকারী পুস্তক, পত্রিকা ও ম্যাগাজিন ছড়িয়ে পড়ল। আর নির্লজ্জতার প্রসারে একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে আগে বাড়তে লাগল।
আরামপ্রিয় বিলাসী জীবন
সুখপ্রিয়তা, বিলাসপ্রেম, অতি সৌখিনতা, দৃষ্টি নান্দনিকতা এবং আত্মিক গুনাহ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, কেমন যেন এগুলোর জোয়ার বইছিল। উত্তম চরিত্র, নৈতিকতা, মৌলিক দ্বীনি শিক্ষা এবং হালাল-হারামের পার্থক্য করার জ্ঞান মনে হয় সে জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল। সময়টা এমন হয়েছিল যে, যে সমস্ত লোক আল্লাহর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে পূরণ জ্ঞান রাখত, অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা ছিল, তার কখনও কখনও এই ভয়ে আসমানের দিকে মুখ তুলত যে, আল্লাহ না করুন! এই বুঝি আল্লাহর গজব এসে পড়ল।
আর এই আয়াত পাঠ করত,
أَفَأَمِنَ أَهْلُ الْقُرَى أَنْ يَأْتِيَهُمْ بَأْسُنَا بَيَاتًا وَهُمْ نَائِمُونَ -أَوَأَمِنَ أَهْلُ الْقُرَى أَنْ يَأْتِيَهُمْ بَأْسُنَا ضُحًى وَهُمْ يَلْعَبُونَ -أَفَأَمِنُوا مَكْرَ اللَّهِ فَلَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ
ঐ নগরবাসী কি সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করছে? যে তাদের উপর আমার আজাব আসতে পারে এমতাবস্থায় তারা ঘুমন্ত।
তাদের কি এই ভয় নেই ? যে, দিনের বেলা আমার আজাব আসতে পারে যখন তালা খেলা-ধূলায় মত্ত থাকে?
ঐ সমস্ত জালেমরা কি আল্লাহর ক্রোধ থেকে ভয়হীন হয়ে পড়ল? আল্লাহর ক্রোধ থেকে তো একমাত্র ক্ষতিগ্রস্তরাই নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।
(আল-আরাফ-৯৭-৯৯)

Facebook
Twitter
LinkedIn

Leave a Reply