দ্যা বিলিভার্স: সাহাবিদের ঈমান আনার অবিস্মরণীয় ঘটনা। পর্ব – ০১

সাহাবিদের ঈমান আনার অবিস্মরণীয় ঘটনা

The Believers: A Book By Ha-mim Zubaer
পাহাড়ের নিরবতা এবং প্রথম ‘হ্যাঁ’
খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.): আস্থা ও ভালোবাসার প্রথম আশ্রয়

সাহাবিদের ঈমান আনার অবিস্মরণীয় ঘটনা।

মক্কার রাত গভীর। চারপাশের পাথুরে পাহাড়গুলো যেন আকাশের তারার আলোয় স্নান করে আরও নীরব, আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। ঘরের ভেতর মৃদু প্রদীপের আলোয় জেগে আছেন এক মহীয়সী নারী—খাদিজা। তাঁর দৃষ্টি বারবার চলে যাচ্ছে হেরা পর্বতের দিকটায়, যেখানে তাঁর প্রিয়তম স্বামী মুহাম্মদ (ﷺ) এখনও ফেরেননি।

দীর্ঘদিন ধরেই তিনি দেখছেন, তাঁর স্বামী শহরের কোলাহল আর অন্তঃসারশূন্য প্রথা ছেড়ে হেরা পর্বতের নির্জনতায় ধ্যানমগ্ন থাকছেন। খাদিজা তাঁর এই একাকীত্বকে সম্মান করেন। তিনি জানেন, তাঁর স্বামী সাধারণ কেউ নন। তাঁর সততা, তাঁর দয়া, তাঁর চিন্তার গভীরতা—এই সবকিছুই তাঁকে বাকি সবার থেকে আলাদা করে তুলেছে। তিনি নিছক একজন অপেক্ষারত স্ত্রী নন; তিনি তাঁর স্বামীর আধ্যাত্মিক যাত্রার নীরব সঙ্গী ও সমর্থক। তিনি অনুভব করতে পারেন, এই নির্জনবাস এক গভীর সত্যের অনুসন্ধানেরই অংশ। কিন্তু আজ কেন যেন তাঁর হৃদয় এক অজানা আশঙ্কায় ছেয়ে আছে। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

অবশেষে দরজায় মৃদু করাঘাত। খাদিজা প্রায় ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন। কিন্তু দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে তাঁর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। এ তো তাঁর চিরচেনা শান্ত, সৌম্য মুহাম্মদ (ﷺ) নন! তাঁর মুখ বিবর্ণ, প্রশস্ত কপালজুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। চোখের দৃষ্টিতে রাজ্যের বিস্ময় আর ভয়। মরুভূমির রাতের শীতলতা নয়, বরং এক মহাজাগতিক অভিজ্ঞতার ভারে তাঁর শরীর হিম হয়ে আছে।

ঘরে প্রবেশ করেই কম্পিত স্বরে তিনি শুধু দুটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন, “যাম্মিলুনি, যাম্মিলুনি!”—“আমাকে আবৃত করো, আমাকে আবৃত করো!”

সাধারণ কোনো নারী হলে হয়তো ভয়ে চিৎকার করে উঠতেন, কিংবা অসংখ্য প্রশ্ন করে স্বামীকে আরও বিচলিত করে তুলতেন। কিন্তু খাদিজা ছিলেন অসাধারণ। তিনি এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। কোনো প্রশ্ন না করে পরম মমতায় তাঁর স্বামীকে একটি চাদরে জড়িয়ে নিলেন। নিজের বুকের উষ্ণতায় তাঁকে আশ্রয় দিলেন। তাঁর কাঁধে হাত রেখে ভরসা জোগালেন, যতক্ষণ না তাঁর কম্পন ধীরে ধীরে কমে এলো। তিনি শুধু একজন স্ত্রী নন, হয়ে উঠলেন তাঁর আশ্রয়, তাঁর প্রথম নিরাপদ ঠিকানা।

কিছুটা শান্ত হলে মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর জীবনের সেই অলৌকিক ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলেন। হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমন, যিনি তাঁকে বাহু দিয়ে এমনভাবে চেপে ধরেছিলেন যে তাঁর নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর সেই অমোঘ নির্দেশ, “পড়ুন!” নিরক্ষর মুহাম্মদ (ﷺ) উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি তো পড়তে জানি না।” তিনবার এমন হওয়ার পর সেই ফেরেশতা তাঁকে শুনিয়েছিলেন ঐশী বাণী, যা মানবজাতির ইতিহাসে এর আগে কেউ শোনেনি।

ঘটনাটি বর্ণনা করে তিনি খাদিজার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার তো নিজের জীবনের ভয় হচ্ছে।”

এই ছিল সেই যুগান্তকারী মুহূর্ত। যে মুহূর্তে একজন মানুষের শতাব্দীর বিশ্বাস, সমাজের প্রথা আর পরিচিত জগতের বাইরের এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। খাদিজার সামনে ছিলেন তাঁর চল্লিশ বছরের বিশ্বস্ত স্বামী, যিনি জীবনে একটিও মিথ্যা বলেননি। আর তাঁর বর্ণনায় ছিল এমন এক ঘটনা, যা কোনো যুক্তিতেই মেলানো যায় না। একপাশে স্বামীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস, অন্যপাশে যুক্তিকে হার মানানো এক অবিশ্বাস্য বিবরণ।

খাদিজা এক মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করলেন না। তাঁর কণ্ঠ থেকে যা উচ্চারিত হলো, তা ছিল মানব ইতিহাসে বিশ্বাসের প্রথম প্রামাণ্য দলিল। গভীর আস্থা ও ভালোবাসায় সিক্ত কণ্ঠে তিনি বললেন:

“কখনোই নয়! আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনোই অপমানিত করবেন না। কারণ আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অসহায়দের ভার বহন করেন, নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করেন, অতিথির সেবা করেন এবং দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ান।”

তাঁর এই কথাগুলো কোনো শূন্য আশ্বাস ছিল না। এটি ছিল চল্লিশ বছর ধরে খুব কাছ থেকে দেখা এক মানুষের চরিত্রের জীবন্ত সাক্ষ্য। খাদিজার চোখের সামনে ভাসছিল সেই দৃশ্যগুলো—কীভাবে মুহাম্মদ (ﷺ) দুঃস্থ আত্মীয়দের খুঁজে খুঁজে সাহায্য করেন, কোনো বিধবার বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নেন, নিজের সামান্য উপার্জন থেকে এতিমদের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দেন। তিনি এমন এক সমাজের মানুষ, যেখানে অতিথিসেবা সম্মানের প্রতীক, আর তাঁর স্বামী সেই সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করেন। খাদিজার কথাগুলো ছিল তাঁর চরিত্রের প্রতি অবিচল আস্থার এক বলিষ্ঠ ঘোষণা: যে সত্তা আপনাকে এমন মহৎ চরিত্র দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তিনি আপনাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না।

এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম ‘হ্যাঁ’। কোনো অলৌকিক ঘটনা দেখে নয়, বরং একজন মানুষের চরিত্রের প্রতি অবিচল আস্থা থেকে জন্ম নেওয়া বিশ্বাস। খাদিজা তাঁর স্বামীর সততাকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে ঐশী সত্যকে গ্রহণ করে নিলেন। তিনি শুধু বিশ্বাস স্থাপন করেই থেমে থাকেননি; তিনি প্রজ্ঞার সাথে পরবর্তী পদক্ষেপটিও নিলেন। তাঁর জ্ঞানী চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে মুহাম্মদকে (ﷺ) নিয়ে গেলেন, যিনি পূর্ববর্তী আসমানি কিতাব সম্পর্কে জানতেন। ওয়ারাকার সত্যায়ন খাদিজার বিশ্বাসকে আরও মজবুত করলো।

সেই রাতে হেরা পাহাড়ের গুহায় যে আলোর সূচনা হয়েছিল, খাদিজা (রা.) ছিলেন সেই আলোর প্রথম প্রদীপ। তিনি শুধু প্রথম বিশ্বাসীই ছিলেন না; তিনি ছিলেন সেই নবীর আশ্রয়, যাঁর উপর পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী দায়িত্ব অর্পিত হতে যাচ্ছিল। তিনি ছিলেন সেই চাদর, যা শুধু কম্পিত শরীরকেই নয়, বরং এক নতুন ইতিহাসের উন্মোচনে ভীত এক নবীর আত্মাকেও পরম মমতায় আবৃত করেছিল।

শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা

  • চরিত্রের শক্তিতে বিশ্বাস: খাদিজা (রা.) কোনো প্রমাণ বা অলৌকিক ঘটনা ছাড়াই বিশ্বাস করেছিলেন, কারণ তিনি মুহাম্মদ (ﷺ)-এর চরিত্রের উপর পূর্ণ আস্থা রাখতেন। এটি শেখায় যে, সততা ও উত্তম চরিত্রই বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় ভিত্তি। একজন মানুষের কর্ম ও নৈতিকতাই তাঁর কথার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
  • সংকটে প্রথম আশ্রয়: একজন জীবনসঙ্গীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো সঙ্গীর বিপদের মুহূর্তে তাঁর মানসিক আশ্রয়স্থল হওয়া। খাদিজা (রা.) প্রশ্ন বা সংশয় দিয়ে নয়, বরং সেবা, আস্থা এবং নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি শিখিয়েছেন যে, ভালোবাসার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ প্রকাশ হলো ভরসা দেওয়া।
  • আবেগের ঊর্ধ্বে প্রজ্ঞা: তিনি শুধু আবেগপূর্ণ সমর্থন দিয়েই থেমে থাকেননি, বরং ওয়ারাকার কাছে গিয়ে ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করার মতো প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে, প্রকৃত বিশ্বাস অন্ধ হয় না। বিশ্বাস ও প্রজ্ঞা একে অপরের পরিপূরক, যা সত্যকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
  • সক্রিয় বিশ্বাস: বিশ্বাস শুধু অন্তরে ধারণ করার বিষয় নয়, বরং কাজের মাধ্যমে তা প্রকাশ করার নামই প্রকৃত বিশ্বাস। খাদিজা (রা.)-এর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল তাঁর বিশ্বাসের সক্রিয় রূপ। তিনি শুধু মুখে বলেননি ‘আমি বিশ্বাস করি’, বরং নিজের কাজ দিয়ে সেই বিশ্বাসের প্রথম সাক্ষী হয়েছেন।

Facebook
Twitter
LinkedIn

Leave a Reply