আরব বিশ্বের ট্রাজেডি: ২য় পর্ব

আরব জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আরব জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা এবং গঠন। যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আরবদের জীবন প্রণালী, তাদের উৎসাহ এবং অনুভূতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই জাতীয়তাবোধ ইসলামি জাতীয়তাবাদের উপর পর্দা ফেলে দিয়েছিল। এমনকি এটি একটি বিশ্বাস ও ধর্মের রূপ ধারণ করেছিল। তার সংজ্ঞা এমনভাবে মুখস্থ করানো হচ্ছিল, এর বিস্তারে এতটাই মনোযোগ দেয়া হয়েছিল,এ বং এতটা আন্তরিকতার সাথে করা হচ্ছিল যেমন দুনিয়া বিভিন্ন ধর্মপ্রবর্তকেরা তাদের ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে করে ছিল এবং এর জন্য খেলা-ধূলার আয়োজন পর্যন্ত করা হচ্ছিল।
সাহিত্য-কবিতা, লেখনী-সংকলন, ইতিহাস-দর্শন, পত্রিকা-রেডিও সবকিছুই এর প্রচারে ওয়াকফ করা হয়েছিল। লেখক-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী-কলামিস্ট, ঐতিহাসিক-দার্শনিক, কবি-সাংবাদিক সবাই এর প্রচার-প্রসার, সৌন্দর্য বর্ণনা, রং-ঢং লাগয়ে উপস্থাপনে আত্মনিয়োগ করেছিল।
এর ফল স্বরূপ পেলাম, ইসলামের অবমাননা, নবুওয়াতে মুহাম্মাদির প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞা এবং নিয়ামতের কৃতঘ্নতার অভিশাপ। যার ফলশ্রুতিতে এবং অবদানে আরব বিশ্বে শিক্ষিত যুবক, চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী, পথপ্রদর্শক এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জবানি ও লেখনী থেকে বের হয়ে এসেছে এমন কিছু নিন্দনীয় কথা, যার দ্বারা তাদের নাস্তিকতা বা মুরতাদ হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না। আর শরিয়তের বিবেচনায়ও তারা সেটিরই যোগ্য।
ইসলাম এবং নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর সাথে শত্রুতা
অনেক আবেগ প্রবণ ও বাচাল প্রকৃতির লোকেরা তাদের বক্তৃতা ও রচনা শুরুর আগে আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) এর পরিবর্তে আরব জাতীয়তাবাদ ও আরব্য মর্যাদা এবং বড়ত্বের কথা (আরব জাতীয়তাবাদের নামে এবং আরবদের মর্যাদা ও বড়ত্বের নামে শুরু করছি) বলে শুরু করত।
সরকারি নথি-পত্রেও এমন কিছু বিষয় সংযুক্ত করা হচ্ছিল, যেগুলোর লেখকদের ইসলামের সাথে শত্রুতা, বিরোধিতা, অবাধ্যতা, বেপরোয়াভাব এবং অমুখাপেক্ষিতার বিষয়ে কোন প্রকার দ্বিধা থাকে না। কিছু কিছু কলামিস্ট আধুনিক আরব সমাজকে এতটাই উন্নাসিক ও বেপরোয়া বলে অভিহিত করেছেন যে তারা সকল আসমানি ধর্ম, মৌলিক বিশ্বাস এবং চারিত্রিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধিকেও অস্বীকার করে।
এরকম চেতনাধারি একজন আরব সেনা অফিসার, যিনি স্বনামধন্য একটি আরব সাম্রাজ্যের সেনা কমান্ডার ছিলেন। সে তার সরকারের বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লিখেছিলেন, এবং শুধু তিনিই নন, সে সময়ের অধিকাংশ সেনা অফিসার জাতীয় নেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার চিন্তা-চেতনা এক রকমেরই ছিল।
সে তার রচনায় লিখেছিল-
‘আরব জাতি আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছিল, ইসলাম ও পুরাতন খৃস্ট ধর্মের কাছে সাহায্য চেয়েছিল, জায়গিরতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের কাছে হাত পেতেছিল, ইরানিদের দুয়ারে ধরনা দিয়েছিল, মধ্য যুগের পর বিভিন্ন প্রসিদ্ধ সাম্রাজ্যের কাছে গিয়েছে কিন্তু কেহই তাদের সামান্যতম উপকারও করেনি।
এরপর আরবরা নিজেদের কৌশল এবং বুদ্ধির জোরে উপরের দিকে চোখ তুলে তাকাতে শুরু করল এবং নিজেদের নতুন প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করল, আর তাদের অব্যর্থ প্রচেষ্টার ফলে ধীরে ধীরে উন্নতি করতে শুরু করল। আর এই নব্য আরব সন্তানেরা আরব জাতীয়তাবাদেরই সন্তান।
আর ঐ সমস্ত রোগ ও দুর্বলতা যা সমাজে দেখা যায়, তা মূলত জায়গিরতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের ফসল এবং তাদেরই সৃষ্ট। ঐ সমস্ত পরাশক্তি, যারা আরবদেরকে অলস ও অকর্মণ্য, সাহসহারা ও বেকার এবং ভাগ্যের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণকারী বানিয়ে দিয়েছিল, এমন মানুষ বানিয়ে দিয়েছিল যাদের লা-হাওলা ওয়া লা-কুউওতা ইল্লা-বিল্লাহ পড়া ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না।
নতুন শক্তি যা নব্য আরব তৈরি করছে, যারা ঐ অত্যাচারী সন্ত্রাসের কবল থেকে আরবকে মুক্তি দিয়েছে। যা একটি নতুন বিপ্লব ও একটি নতুন সমাজের জন্ম দিবে। যে সমাজে মানুষ শুধু মানুষের উপরই ভরসা করবে।
আরব্য সংস্কৃতির পুনর্জীবন দান এবং আরব সামাজিকতা পুন:প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় হচ্ছে, একটি নতুন সামাজিক আরব জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলা। যাদের একমাত্র বিশ্বাস হবে, আল্লাহ, ধর্ম, জায়গীরতন্ত্র, ধনতন্ত্র এসব কিছু হচ্ছে পুরনো দিনের সমাজ ব্যবস্থায় প্রযোজ্য ছিল। এসব কিছু ইতিহাসের যাদুঘরে মমি করে রাখা লাশের মত বৈ কিছুই নয়।
যখন আমরা এ শর্ত আরোপ করব যে, আমাদের নতুনদেরকে পুরনো সব কিছু অস্বীকার করতে হবে। তাদের কিছু নতুন নির্ধারিত শক্তি থাকবে। আর ঐ সমস্ত নতুন শক্তির উপরেই সকলে ঈমান থাকবে, এবং ঐ সমস্ত ব্যক্তিরা শুধু নিজের অস্তিত্বের উপর, নিজের কর্মের উপর এবং ঐ জিনিসের উপর যা সে মানুষকে দিতে পেরেছে তার উপর ভরসা করবে।
আর এটা এ জন্য করবে , কেননা সে জানে যে, তার শেষ পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু। মৃত্যু-ছাড়া আর কিছুই নেই। জান্নাত-জাহান্নাম ওসব কিছুই না। বরং সে একটি কণায় পরিণত হবে এবং তা এক সময় মাটির সাথে মিশে যাবে। এ জন্যই সে বাধ্য এ চিন্তা করতে, যে সে যা কিছু করবে সব কিছু কোন প্রতিদানের (জান্নাত এর মধ্যে সামান্য একটু স্থান ইত্যাদি) আশা ছাড়াই নিজ জাতি ও মানবতার জন্য উৎসর্গ করে দিবে।
(দামেস্ক থেকে প্রকাশিত জাইশুশ-শায়াব গ্রন্থের অন্তর্গত “আল-ইনসানুল আরাবিয়্যুল জাদীদ” প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত)

মূল: আবুল হাসান আলি নদবি রহ.

-অনুবাদ ও সম্পাদনায়: হা-মীম যুবায়ের

Facebook
Twitter
LinkedIn

Leave a Reply